(১)
আমরা বাসাবোর আরএফএল বেস্টবাই শোরুমের পেছনের ৬ তলা ভবনের পঞ্চম তলায় থাকি।
কয়েক বছর ধরেই আমরা এখানে রয়েছি।
আমাদের পাশের বিল্ডিংটা ৫ তলা এবং কিছুটা নীচু।একটু ঝুঁকি নিলে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ থেকে আমাদের জানালা দিয়ে জিনিসপত্র আদানপ্রদান করা যায়।
পুরোনো হওয়ায় ওই বিল্ডিংয়ের ছাদটা বেশ স্যাঁতসেঁতে।
ছাদে বেশ কয়েকটা লেবু, পেয়ারা ও গোলাপ গাছ রয়েছে।
অনেকদিন হলো গাছগুলোয় পানি দেয়া হয়না।
ধুলোবালি পড়ে পাতাগুলোর রঙ বদলে গেছে।
বিল্ডিংটা আমাদের বিল্ডিংয়ের উত্তরে অবস্থিত, ছাদের পশ্চিম দিকের অর্ধেকে বেশ বড়সড় একটা সুন্দর সিঁড়িঘর রয়েছে।
ওখানে হয়তো একটা ছোট্ট ফ্যামিলি বসবাস করে।
ভালবাসার মানুষটাকে না পেয়ে আমি মানসিকভাবে ভেঙে পড়লাম।
সবসময় মন খারাপ করে বসে থাকি।
গোসল, খাওয়া, ঘুম কোনোকিছুরই ঠিক নেই।
কষ্ট লাঘবের জন্য সিগারেট ধরলাম।
বাইরে বাইরে সিগারেট ফুকতে ফুকতে একসময় রুমে এনে সিগারেট টানার অভ্যেস হয়ে গেলো।
ছোটভাইটা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে গেলে প্যান্টের পকেটে লুকিয়ে রাখা সিগারেট আর দিয়াশলাই বের করে জানালার পাশে বসি।
প্রিয়তমার কথাগুলো মনে করি আর সিগারেট ফুকি।
হারিয়ে যাওয়া মানুষের দেয়া সুখের স্মৃতিগুলো মনে হতেই চোখের কোণে জল জমে, শ্বাসকষ্ট হয়।
মাঝেমধ্যে কয়ে ফোঁটা জল গড়িয়ে চিবুক বেয়ে নীচে নেমে যায়।
মাঝেমধ্যে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠি।
ভয় হয় ঘুমিয়ে যাওয়া ছোট ভাইটা যদি জেনে যায় !
চরম লজ্জায় পড়ে যাব।
সন্ধ্যায় বাহির থেকে ফেরার সময় দুই শলাকা সিগারেট ও এক টাকার একটা ম্যাচ আনতে ভুলিনি।
রাতে সবাই গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলে প্রিয়তমার স্মৃতি বিসর্জন সরূপ সিগারেট পূজো করবো।
রাত তখন বারোটা।
সায়েম গভীর ঘুমে তলিয়ে গেছে।
ভারী শ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ পেতে শুরু করলাম।
ফোনটা বালিশের পাশে রেখে সিগারেট আর ম্যাচ হাতে জানালার পাশে বসলাম।
জানালা খুলে দিতেই উত্তর থেকে ধেয়ে আসা শীতল বাতাসে শরীরে শীত অনুভূত হচ্ছে।
সিগারেট জ্বালিয়ে টানছি আর মায়াময়ীর কথা স্মরণ করছি।
একটা সিগারেট শেষ করে ফিল্টারটা জানালা দিয়ে বাহিরে ফেলতে যাব এমন সময় সুন্দর সুরেলা কন্ঠে কে যেন গান গেয়ে উঠলো !
অতি সুমিষ্ট নারী কন্ঠ।
চমকে উঠে পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদের দিকে তাকালাম।
অন্যান্য বিল্ডিং থেকে আসা ঝাপসা আলোতে মানুষটাকে ঠিক চেনা যাচ্ছেনা।
হাসনাহেনা ফুলের গন্ধ আসছে।
ছাদে হাসনাহেনা গাছ আছে কি না দেখা দরকার।
হয়তো মেয়েটা হাসনাহেনা ফ্লেভারের বডি স্প্রে মেখেছে।
মুগ্ধ শ্রোতার মত ‘থ’ মেরে বসে আছি।
আবছা আলোয় বসে কেউ একজন গেয়ে চলেছে রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত গান
মম মন-উপবনে চলে অভিসারে
আঁধার রাতে বিরহিণী।
রক্তে তারি নূপুর বাজে রিনিরিনি।
দুরু দুরু করে হিয়া,
মেঘ ওঠে গরজিয়া,
ঝিল্লি ঝনকে ঝিনিঝিনি।।
মম মন-উপবনে ঝরে বারিধারা
গগনে নাহি শশীতারা।
বিজুলির চমকনে মিলে আলো ক্ষণে ক্ষণে
ক্ষণে ক্ষণে পথ ভোলে উদাসিনী।
অবাক হয়ে শুনে চলেছি।
মেয়েটা বেশ কয়েকটা গান গাইলো।
সবগুলোই আমার পছন্দের, শেষ গানটা তো ভালবাসার মানুষের পছন্দের ছিল।
এই মেয়েটা জানলো কি করে !
মোহনার পছন্দের গান শুনে তার কথা মনে পড়লো।
মনটা অবসন্ন হয়ে উঠলো।
রাত ৩ টার দিকে গান বন্ধ হয়ে গেলো।
শেষ সিগারেটটা বের করে ধরালাম। এরপর দেখলাম মেয়েটি উঠে গিয়ে সিঁড়িঘরে প্রবেশ করলো।
অনেক চেষ্টা করেও মুখটা দেখতে পারলাম না।
সিঁড়িঘরের বাতি নিভে গেলো।
সিগারেট শেষ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
(২)
পরদিন রাতের খাওয়া শেষ করে টিভি দেখলাম।
বিশেষ নৃত্যানুষ্ঠানে সেলিব্রিটিরা নাচ করলো।
দেশের সবচেয়ে বড় বড় নৃত্য গুরুরা উপস্থিতি ছিলেন।
ঘুমুতে যাবার আগে দেশের হালচাল জানার জন্য খবর দেখলাম।
ইদানীং দেশের কি যেন হয়েছে !
চারিদিকে শুধু মৃত্যুর মিছিল। রোড এক্সিডেন্ট, ধর্ষণ, মারামারি ইত্যাদি।
এছাড়াও রয়েছে চমকপ্রদ কিছু নেতা নেতৃর কুকর্ম ফাঁস। ঘুষ ও দূর্নীতি করে টাকার পাহাড় গড়ার নিউজ।
মানুষের যেন ধর্মের ভয় নেই। নেই মৃত্যুর ভয়।
সবাই অকাম কুকাম করেই চলেছে।
ছোটভাইটা আগেই এসে ঘুমিয়ে পড়েছে। রাত প্রায় ১ টা বেজে গেছে। সিগারেট হাতে জানালায় এসে বসলাম। পর্দা সরিয়ে থাই গ্লাসটা খুলতেই বিষ্ময়ে অভিভূত হলাম।
পাশের বিল্ডিংয়ের ছাদ চমৎকার করে সাজানো হয়েছে। সাউন্ড বক্স এসেছে।
লাইটিং করা হয়েছে। সব মিলিয়ে অসাধারণ ডেকোরেশন।
বেশ কয়েকজন অতিথি এসেছেন। সবার একই পোষাক। সাদা কান্দুরা ড্রেস পরে চেয়ারে বসে আছেন অতিথিরা।
চেয়ার গুলো চারপাশে গোল করে সাজানো।
মাঝখানে অসাধারণ সাজে সজ্জিত একজন লাস্যময়ী নারী নৃত্য করে চলেছে।
এত সুন্দর রমনী এর আগে কখনো দেখেছি বলে মনে হচ্ছেনা।
সাউন্ড বক্সে গান বাজছে,
মম চিত্তে
নীতি নৃত্যে
কে যে নাচে
তা তা থৈ থৈ
তা তা থৈ থৈ
বেশ কয়েকটা গানে নাচ শেষ হয়ে গেলো। আমি মুগ্ধ দর্শকের মত জানালায় বসে আছি। মেয়েটাকে পৃথিবীর সবচেয়ে রূপবতী মনে হচ্ছে। যেন স্বর্গ থেকে নেমে আসা পরী !
দ্বিতীয় সিগারেটটা জ্বালাবার আগেই অনুষ্টান শেষ হয়ে গেলো।
তৃপ্তি নিয়ে বিছানায় এসে ঘুমিয়ে পড়লাম।
(৩)
আজ আর টিভি দেখলাম না।
সিগারেট আনতেও ভুলে গিয়েছি।
সারাদিন বাহিরে বাহিরে থাকায় আজ শরীরটা বেশি ক্লান্ত।
খাওয়াদাওয়া শেষ করে রাত ১১ টার দিকে শুয়ে পড়লাম।
বিছানায় গড়াগড়ি করছি। ঘুম আসছেনা।
হয়তো সিগারেট আনা হয়নি তাই টেনশন হচ্ছে।
রাত ১টার দিকে স্বভাবতই জানালার পাশে বসলাম।
থাই গ্লাসটা খুলে দিতেই মন খারাপ হয়ে গেলো।
সিঁড়িঘরে যেই পরিবার থাকে সেই পরিবারের কেউ একজন মৃত্যুবরণ করেছে।
শহরে কেউ মারা গেলে পাশের বিল্ডিংয়ের মানুষ জানেনা। আমাদেরও তাই হয়েছে। পাশের বিল্ডিংয়ের সিঁড়িঘরে থাকা পরিবারের কেউ মৃত্যুবরণ করেছে অথচ আমরা টেরই পাইনি !
খাটিয়াতে লাশ শুইয়ে রাখা হয়েছে।
চেয়ারে কয়েকজন মানুষ চুপচাপ বসে আছেন।
সিঁড়িঘর থেকে মাঝেমধ্যে কান্নার আওয়াজ আসছে।
কখনো পুরুষ, কখনো নারী, কখনো বাচ্চাদের কান্নার আওয়াজ পাচ্ছি।
কে মারা গেছে জানা দরকার। তবে কাউকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করছেনা।
অর্ধেক চাদরে লাশটার বুক পর্যন্ত ঢেকে দেয়া হয়েছে।
একজন কিছুক্ষণের জন্য লাশের মুখটা খুলে কাকে যেন দেখালো।
আমিও দূর থেকেই দেখতে পেলাম।
আলো ঝলমলে মুখ।
সুন্দর করে সুরমা, কর্পুর দিয়ে সাজানো হয়েছে।
কাল রাতে নৃত্য করা মেয়েটার লাশ !
মনটা খারাপ হয়ে গেলো। গত রাতে যেই মানুষটা এত সুন্দর করে নৃত্য করলো সে আজ মৃত।
ভাবতেই খারাপ লাগছে।
রাত তিনটার দিকে সবাই খাটিয়া ধরে ছাদ থেকে সিড়ি বেয়ে নেমে গেলো।
আমি চুপচাপ দেখলাম।
তারপর মন খারাপ করে ঘুমিয়ে গেলাম।
(৪)
গত রাতের মেয়েটার মৃত্যুটা কেন যেন মেনে নিতে পারছিনা।
সারাদিন এটা নিয়েই ভাবতে থাকলাম।
একটা কাজে দুপুরে পাশের বিল্ডিংয়ের গেটের সামনে গিয়েছিলাম।
বিকেলে পাশের বিল্ডিংয়ের কেয়ার টেকার মফিজ মিয়ার সাথে চায়ের দোকানে দেখা।
মফিজ মিয়াকে বললাম, চাচা আপনাদের বিল্ডিংয়ের সামনে গিয়েছিলাম আপনাকে পাইনি; সিঁড়িঘর তো ভাড়া দিয়েই দিয়েছেন তাহলে এখনো গেটে বিজ্ঞপ্তি দেয়া কেন?
মফিজ মিয়া বললেন, বুঝলাম না বাবা !
আমি বললাম, বলছি সিঁড়িঘরে নতুন ভাড়াটিয়া উঠেছে অথচ গেটে এখলো “সিঁড়িঘর ভাড়া দেয়া হবে” লিখা বিজ্ঞপ্তি দিয়ে রেখেছেন ব্যাপার কি?
মফিজ মিয়া বললেন “কই সিঁড়িঘরে তো নতুন কোনো ভাড়াটিয়া ওঠেনি বাবা ! একমাস হলো ওটা খালি পড়ে আছে !”
মফিজ মিয়ার কথা শুনে আমার শরীরে বিদ্যুতের ঝটকা লাগলো। বুক ধড়ফড় করছে। শ্বাসপ্রশ্বাস দ্রুত থেকে দ্রুততর হচ্ছে। সবকিছু অন্ধকার হয়ে আসছে। পানির পিপাসা পাচ্ছে, শরীর নিস্তেজ হয়ে আসছে।
বারবার ভাবছি, ভাড়াটেই যদি না থাকে তাহলে…….
গল্পঃ সিঁড়িঘর
লিখেছেনঃ অনুপম হোসাইন
Nice bro
Thanks vai.